by Tarekuzzaman Tarek
পৃথিবী হলো দারুল ইবতিলা বা পরীক্ষাগৃহ। পার্থিব এ জীবন বান্দার জন্য এক মহাপরীক্ষা। প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি অবস্থায় তাকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হয়। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই শয়তান এসে পদস্খলন ঘটাতে চেষ্টা করে। বিশেষ করে বিপদের নাজুক মুহূর্তে এসে বান্দাকে অস্থির ও অধৈর্য করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালায়। কারণ, সে জানে, এ সময়ে বান্দাকে বিভ্রান্ত করা অনেক সহজ। আর তাই মুমিন বান্দাকে এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে; যেন শয়তান এসে আমাকে ধোঁকায় না ফেলে দেয়। শত বিপদ-মুসিবত আসুক না কেন, সবই মাথা পেতে নিলে গায়ে সয়ে যাবে। অধৈর্য হলে পেরেশানি বাড়বে বৈ কমবে না।
বস্তুত পার্থিব জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য, আখিরাতের পরীক্ষায় পাশ করার জন্য সবরের কোনো বিকল্প নেই। সবর আমাকে অর্জন করতেই হবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সবরকে সাথে নিয়ে চলতে হবে। দ্বীনের পথে যে যত বড়, তার সবরের পরিমাণও তত বেশি। এজন্যই দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি কষ্ট-মুসিবতের শিকার হন আম্বিয়ায়ে কিরাম। এরপর সিদ্দিকিন, শুহাদা ও সালিহিন। এভাবেই পর্যায়ক্রমে দ্বীনের পথে তাঁরা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। দাওয়াতের মেহনত নিয়ে আগমনকারী প্রথম নবি নুহ আ. থেকে নিয়ে সর্বশেষ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত এমন কোনো নবি নেই, যাঁকে আল্লাহর পথে অভাবনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়নি। তাঁরা সব বাধা পেরিয়ে তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন।
পার্থিব জীবনে বিপদ যেহেতু অবশ্যম্ভাবী একটি বিষয়, বিধায় এটাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। এরপর ধৈর্য ও সবরের প্রশিক্ষণ নিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে সব ধরনের বিপদে স্থির থাকার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এজন্য ইসলামে সবরের ব্যাপারে অসংখ্যবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেননা, সকল বিপদাপদের একমাত্র সহজ ও উত্তম উপশম হলো সবর। এ প্রবন্ধে আমরা আজ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা বিপদ-মুসিবত ও সবর নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এসংক্রান্ত আলোচনা আমরা দুটি অধ্যায়ে দালিলিকভাবে তুলে ধরছি। প্রথম অধ্যায়ে বান্দাদের পরীক্ষা করার ব্যাপারে কুরআন-হাদিসের বিভিন্ন নির্দেশনা তুলে ধরা হবে। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে থাকবে বান্দা কীভাবে এসব বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করবে, তার বিশদ আলোচনা। তিনিই তাওফিকদাতা ও সাহায্যকারী।
প্রথম অধ্যায় : ইবতিলা (বিপদ-মুসিবত)
বান্দার ওপর বিপদ-মুসিবত আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এতে ভেঙে পড়া বা অস্থির হয়ে যাওয়া মুমিন বান্দার জন্য শোভা পায় না। পৃথিবীতে যতদিন হায়াত থাকবে ততদিন বিপদ আসতেই থাকবে। তাই এটাকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মেনে নিতে হবে। পূর্বেই বলে এসেছি যে, তুলনামূলক যারা আল্লাহর অধিক প্রিয় তারাই অধিক বিপদের সম্মুখীন হয়। হাদিসেও এমনটাই বলা হয়েছে।
সাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً؟ قَالَ: الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ، فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلاَؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَمَا يَبْرَحُ البَلاَءُ بِالعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ.
‘আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন, নবিদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা নেককার তাদের, এরপর যারা নেককার তাদের বিপদের পরীক্ষা। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের অনুপাত অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশি ধার্মিক তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে। আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে তাহলে তাকে সে মুতাবিক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, বান্দার ওপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে জমিনে চলাফেরা করে; অথচ তার কোনো গুনাহই বাকি থাকে না। (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৭৯, হা. নং ২৩৯৮, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
তাই বিপদাপদে নিপতিত হওয়াকে খারাপ ভাবা যাবে না; বরং এটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কতা, পরীক্ষা বা গুনাহ মাফের অসিলা মনে করে ধৈর্যধারণ করতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহয় মুমিনদের বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করার ব্যাপারে অনেক নস এসেছে। আমরা এখানে সেসব হতে কতিপয় নস উল্লেখ করছি।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ
‘আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। আর সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৫৫)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি বিভিন্নভাবে বান্দাদের পরীক্ষা করবেন। কখনো শত্রুদের ভীতির মাধ্যমে, কখনো অভাব-অনটনের মাধ্যমে, কখনো সম্পদ ও ফল-ফসল বিনষ্ট করার মাধ্যমে আর কখনো বান্দার প্রিয় কারও জান নেওয়ার মাধ্যমে। আর মুমিনদের ওপর এ ধরনের সব পরীক্ষাই এসে থাকে। তাই পরীক্ষা আসা এটা চিরন্তন। এটা কখনো প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। এ অবস্থা আসলে হা-হুতাশ না করে সবর করতে হবে, যা আয়াতটির শেষে বিবৃত হয়েছে এ বলে “আর সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” অর্থাৎ বিপদ আসলে যারা সবর করতে পারবে, তাদের জন্যই এ বিপদ রহমত ও কল্যাণের কারণ হবে। নচেৎ এ বিপদে অধৈর্য হয়ে শিকায়াত করলে উল্টো বিপদ আরও বাড়ল বৈ কমল না। তাই বুদ্ধিমানরা এতে কখনো অধৈর্য হয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে বসে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
الم. أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ. وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
‘আলিফ লাম মিম। মানুষ কি মনে করে যে, “আমরা ইমান এনেছি” একথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেওয়া হবে? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম। আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন—কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী।’ (সুরা আল-আনকাবুত : ১-৩)
এ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে, ইমান আনলে তাদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতেই হবে। এরপর এর নজির পেশ করেছেন যে, পূর্ববর্তী উম্মতদের যেভাবে বিভিন্ন বিপদাপদ ও মুসিবতের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়েছে, তোমাদেরও তেমনই পরীক্ষা করা হবে। অর্থাৎ ইমানদার হলে পরীক্ষার সম্মুখীন হতেই হবে। আর এ পরীক্ষার মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কারা ইমানের ব্যাপারে সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
‘তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে; অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করোনি, যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের ওপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর তাদের এমনই শিহরিত হতে হয়েছে, যাতে নবি ও তাঁর প্রতি যারা ইমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য! তোমরা শুনে নাও, আল্লাহর সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী।’ (সুরা আল-বাকারা : ২১৪)
এ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তবেই জান্নাতে যাওয়ার আশা করার কখা বলেছেন। পরীক্ষা তা-ও যেই সেই নয়, পরীক্ষার ধরণ এতটাই কঠিন ছিল যে, নবি ও তাঁর উম্মত সবাই পেরেশান হয়ে গেছেন এই ভেবে যে, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে। মূলত আল্লাহর সাহায্য চূড়ান্ত ও শেষ মুহূর্তেই আসে। কিন্তু সে পর্যন্ত অপেক্ষার ধৈর্য খুব কম মানুষেরই থাকে। এজন্যই এটাকে অনেক বড় ও কঠিন পরীক্ষা বলা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
‘অবশ্যই তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও লোকবলের ব্যাপারে পরীক্ষিত হবে এবং নিশ্চয়ই তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার।’ (সুরা আলি ইমরান : ১৮৬)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রথমে মুমিনদের ধনসম্পদ ও লোকবলের ব্যাপারে পরীক্ষা করবেন জানিয়েছেন। এভাবে যে, ধনসম্পদ ছেড়ে অন্যত্র হিজরত করতে হবে বা ধনসম্পদ কাফিররা দখল করে নেবে বা আসমানি বা দুনিয়াবি কোনো দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে যাবে। লোকবলের ক্ষেত্রে পরীক্ষা এভাবে যে, হয়তো কাউকে শহিদ করে দেওয়া হবে, কাউকে আটকে রাখা হবে, কাউকে নির্যাতন করা হবে, কাউকে দাস-দাসী বানানো হবে ইত্যাদি। এছাড়াও কাফির, মুশরিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কটুক্তিমূলক গালিগালাজ ও সমালোচনা তো থাকবেই। এগুলো বলার উদ্দেশ্য, যেন মুমিনরা জেনে নেয় যে, ইমান আনলেই কাজ শেষ নয়; বরং কাজ সবে শুরুমাত্র। দুনিয়ার জীবনে বিভিন্ন চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে, বিভিন্ন জুলুম-নির্যাতন ও মুসিবত সহ্য করে তবেই সফলতার আশা করা যায়। মুমিনরা যেন আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারে, এজন্য আল্লাহ তাআলা আগেই সব জানিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব; যে পর্যন্ত না জেনে নিই তোমাদের জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদের এবং তোমাদের কর্মকাণ্ড পরীক্ষা করি।’ (সুরা মুহাম্মাদ : ৩১)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা জিহাদ ও জিহাদের পথে পাওয়া কষ্ট সহ্য করার মাধ্যমে পরীক্ষা করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ জিহাদের মাধ্যমেও পরীক্ষা করা হবে যে, কারা এ পথে ধৈর্যধারণ করে লড়াই করে আর কারা এ থেকে পিছে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়েও এ জিহাদের মাধ্যমেই মুনাফিকরা চিহ্নিত হয়ে যেত। কারণ, জিহাদের ডাক আসলেই তারা বিভিন্ন তাল-বাহানা দেখিয়ে জিহাদ থেকে নিবৃত্ত থাকতে চাইত এবং শরয়ি কোনো ওজর ছাড়াই ঘরে বসে থাকত। বুঝা যায়, মুমিন ও মুনাফিকদের চেনার একটি উপায় হলো জিহাদ। মুনাফিকরা কখনও জিহাদ পছন্দ করে না এবং যেকোনোভাবে এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু খাঁটি মুমিনদের কাছে জিহাদ পরম সাধনার জিনিস। এর মাধ্যমেই তো শাহাদাতের পেয়ালা পান করা যায় আর আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়।
হাদিসেও মুমিনদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। জানানো হয়েছে যে, মুমিনদের পরীক্ষা করা ছাড়া কেউ উত্তীর্ণ হতে পারবে না। ব্যক্তির অবস্থান হিসেবে পরীক্ষার ধরনে কমবেশ হবে। একেক জনের জন্য একেক রকমের পরীক্ষা। পরীক্ষার মানের দিক থেকেও অনেক প্রকারের পরীক্ষা করা হয়। ব্যক্তির মান ও অবস্থান যদি সুউচ্চ হয় তাহলে তার পরীক্ষাও হয় অত্যন্ত কঠিন। আর যদি মাঝারি হয়, তাহলে পরীক্ষার মানও মাঝারি হয়ে থাকে। দুর্বল হলে পরীক্ষাও দুর্বলভাবেই নেওয়া হয়।
সাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً؟ قَالَ: الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ، فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلاَؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَمَا يَبْرَحُ البَلاَءُ بِالعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ.
‘আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন, নবিদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা নেককার তাদের, এরপর যারা নেককার তাদের বিপদের পরীক্ষা। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের অনুপাত অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশি ধার্মিক তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে। আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে তাহলে তাকে সে মুতাবিক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, বান্দার ওপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে জমিনে চলাফেরা করে; অথচ তার কোনো গুনাহই বাকি থাকে না।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৭৯, হা. নং ২৩৯৮, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
এ হাদিসে মুমিনের স্তরভেদে পরীক্ষা কঠিন ও হালকা হয়, তার বিবরণ রয়েছে। যে বেশি দ্বীন পালন করে তাকে পরীক্ষাও দিতে হয় কঠিন করে। আর যে পরিমিত আকারে দ্বীন পালন করে তার পরীক্ষাও হয়ে থাকে পরিমিত আকারে। মোটকথা, মুমিনদের পরীক্ষা না দিয়ে উপায় নেই। আল্লাহ কোনো কোনো বান্দাকে এত বেশি মুসিবতে নিপতিত করেন যে, এর কারণে ধীরে ধীরে তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। অতএব মুমিনের ওপর আপতিত বালা-মুসিবতকে সে কল্যাণের কারণ মনে করবে। এতে হতাশ বা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহর কিছু বান্দা এমনও আছেন, যাদেরকে মুসিবত চারদিক থেকে ঘিরে রাখে। সে বিপদাপদের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে, তবুও সে দ্বীনের ওপর অটল থাকে।
আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
أَتَى رَجُلٌ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: وَاللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي لَأُحِبُّكَ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: "إِنَّ الْبَلَايَا أَسْرَعُ إِلَى مَنْ يُحِبُّنِي مِنَ السَّيْلِ إِلَى منتهاه
‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, আমাকে যে ভালোবাসে তার দিকে সকল মুসিবত ও বিপদাপদ বন্যার পানির চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটে আসবে।’ (সহিহু ইবনি হিব্বান : ৭/১৮৫, হা. নং ২৯২২, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এ হাদিসটি আরও স্পষ্ট নির্দেশক যে, মুমিন বান্দাকে মুসিবত এসে কখনো ঘিরে ফেলে। চতুর্মুখী বিপদে দুর্বলরা ভেঙে পড়লেও সবলরা ঠিকই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং সবরের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এভাবেই কুরআন ও সুন্নাহয় আরও অনেক নস পাওয়া যায়, যা থেকে প্রমাণ হয় যে, মুমিনদের ওপর নানা মুসিবত ও বিপদাপদ আসবে। এক্ষেত্রে তাদের করণীয় হলো, এতে ভেঙে না গিয়ে ধৈর্যধারণ করবে। এভাবে বারবার অনুশীলন করলে তার জন্য কঠিন থেকে কঠিন সমস্যায়ও ধৈর্যধারণ করা সহজ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় অধ্যায় : সবর বা ধৈর্য
‘সবর’ শব্দের শাব্দিক অর্থ আটকে রাখা ও বাধা দেওয়া। বস্তুত মনকে উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা থেকে দূরে রাখা, জিহ্বাকে অভিযোগ ও অসন্তষ্টি প্রকাশ থেকে নিবৃত্ত করা এবং মুখ চাপড়ানো ও জামা ছেঁড়া থেকে বিরত থাকাই হলো সবর। আরও সহজে বললে বলা যায়, কুপ্রবৃত্তি ও শরিয়ানিষিদ্ধ কাজে সাড়া না দেওয়াকেই সবর বলে। ইসলামে সবরের অবস্থান, মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক বেশি। আমরা এ অধ্যায় সবরের ফজিলত, তার গুরুত্ব ও অর্জনের উপায় নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। দুটি পরিচ্ছেদে বিষয়গুলোর দালিলিক আলোচনা তুলে ধরছি।
প্রথম পরিচ্ছেদ : সবরের ফজিলত ও গুরুত্ব
কুরআন ও হাদিসে সবরের অনেক ফজিলত ও গুরুত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্নভাবে মুমিনদের এ গুণ অর্জনের প্রতি উৎসাহিত ও ক্ষেত্রবিশেষে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা তন্মধ্য হতে এখানে কিছু নস উল্লেখ করছি। প্রথমে থাকবে কুরআনের আয়াতসমূহ, এরপরে থাকবে হাদিসের বাণীসমূহ।
প্রথমত, কুরআনে কারিম থেকে-
এক : সবরকারীর প্রতিদান অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি দেওয়া হবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
أُوْلَئِكَ يُؤْتَوْنَ أَجْرَهُم مَّرَّتَيْنِ بِمَا صَبَرُوا
‘তাদেরকে দুইবার করে পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে, যেহেতু তারা ধৈর্যধারণ করেছে।’ (সুরা আল-কাসাস : ৫৪)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ
‘সবরকারীদের অপরিমিত পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (সুরা আজ-জুমার : ১০)
দুই : সবর বা ধৈর্যধারণ হলো সফলতার সোপান।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اصْبِرُواْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘হে ইমানদারগণ, তোমরা সবর করো, সবরে প্রতিযোগিতা করো, সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা আলি ইমরান : ২০০)
তিন : সবর মানুষকে দ্বীনের ক্ষেত্রে ইমামত ও নেতৃত্বের উপযুক্ত বানায়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ
‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করত; যেহেতু তারা সবর করেছিল। আর তারা আমার নিদর্শনাবলিতে দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।’ (সুরা আস-সাজদা : ২৪)
চার : সবরকারীদের ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়।আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ . أُولَـئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
‘তুমি সুসংবাদ দাও সবরকারীদের—যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, “আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই আমরা প্রত্যাবর্তনকারী।” ওরা তারাই, যাঁদের প্রতি তাঁদের রবের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়। আর তাঁরাই হলো হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৫৫-১৫৭)
সালাফের কেউ বিপদে পতিত হলে বলতেন, ‘আমার কী হলো! কেন আমি সবর করছি না? অথচ আল্লাহ আমার সাথে ওয়াদা করেছেন, সবর অবলম্বন করলে তিনি আমাকে এরূপ তিনটি নিয়ামত দান করবেন, যার প্রত্যেকটি দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছু থেকে উত্তম।’
পাঁচ : বিপদাপদে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য সবরকে অন্যতম মাধ্যম বানানো হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَاسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ
‘তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহ কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা আল-বাকারা : ৪৫)
ছয় : মানব ও শয়তানের চক্রান্ত থেকে বাঁচার অন্যতম একটি উপায় হলো সবর অবলম্বন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِن تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ
‘তোমরা যদি সবরকারী হও এবং মুত্তাকি হও, তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।’ (সুরা আলি ইমরান : ১২০)
সাত : আল্লাহর সাহায্য লাভ করার অন্যতম মাধ্যম হলো সবর ইখতিয়ার করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
بَلَى إِن تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ وَيَأْتُوكُم مِّن فَوْرِهِمْ هَـذَا يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُم بِخَمْسَةِ آلافٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُسَوِّمِينَ
‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই, যদি তোমরা সবর ও তাকওয়া অবলম্বন করো, আর তারা (শত্রুরা) দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে, তবে আল্লাহ পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন।’ (সুরা আলি ইমরান : ১২৫)
আট : সবরের জন্য ক্ষমা ও উত্তম প্রতিদানের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ
‘কিন্তু যারা ধৈর্যশীল ও সৎকর্মপরায়ণ তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ (সুরা হুদ : ১১)
নয় : সবর করলে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُواْ لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَمَا ضَعُفُواْ وَمَا اسْتَكَانُواْ وَاللّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ
‘আর কত নবি যুদ্ধ করেছে, তাঁদের সঙ্গে ছিল বহু আল্লাহওয়ালা। আল্লাহর পথে যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তাঁরা হীনবল হননি, দুর্বল হননি এবং নত হননি। আর আল্লাহ সবরকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলি ইমরান : ১৪৬)
দশ : সবর করাকে দৃঢ়সংকল্পের কাজ ও প্রশংসনীয় বলা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَلَمَن صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
‘আর অবশ্যই যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয়, এটি তো হবে দৃঢ় সংকল্পেরই কাজ।’ (সুরা আশ-শুরা : ৪৩)
লুকমান আ. তার সন্তানকে উপদেশ দিয়েছেন; কুরআনের ভাষায় :
وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
‘সৎকাজে আদেশ কোরো, অসৎকাজে নিষেধ কোরো এবং আপদে-বিপদে ধৈর্য ধারণ কোরো। এটিই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’ (সুরা লুকমান : ১৭)
দ্বিতীয়ত, হাদিসে রাসুল থেকে-
এক : কোনো দুর্ঘটনা বা বিপদে সবর করে দুআ পড়লে আল্লাহ তার চেয়ে উত্তম জিনিস দান করেন।
উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ تُصِيبُهُ مُصِيبَةٌ، فَيَقُولُ مَا أَمَرَهُ اللهُ: إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ، اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا، إِلَّا أَخْلَفَ اللهُ لَهُ خَيْرًا مِنْهَا "، قَالَتْ: فَلَمَّا مَاتَ أَبُو سَلَمَةَ، قُلْتُ: أَيُّ الْمُسْلِمِينَ خَيْرٌ مِنْ أَبِي سَلَمَةَ؟ أَوَّلُ بَيْتٍ هَاجَرَ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثُمَّ إِنِّي قُلْتُهَا، فَأَخْلَفَ اللهُ لِي رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘কোনো বিপদাপন্ন মুমিন যদি আল্লাহর নির্দেশিত إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (অর্থ : নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করব।) দুআটি পাঠ করে اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا (অর্থ : হে আল্লাহ, আমাকে আমার মুসিবতে সওয়াব দান করো এবং এর বিনিময়ে এর চেয়ে উত্তম বিনিময় দান করো।) দুআটি পড়ে, তবে আল্লাহ তাআলা তাকে পূবের চাইতে উত্তম বদলা দান করবেন। উম্মে সালামা রা. বলেন, আবু সালামা রা. যখন মারা গেলেন তখন আমি মনে মনে ভাবলাম, আবু সালামা রা.-এর চেয়ে উত্তম মুসলমান আর কে আছে! তিনিই প্রথম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে হিজরত করেছিলেন। অতঃপর আমি সেই দুআটি পাঠ করলাম। তারপর মহান আল্লাহ আমাকে আবু সালামা রা.-এর স্থলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মতো স্বামী দান করলেন।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৬৩১, হা. নং ৯১৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
দুই : সবরের বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
আবু হুরাইরা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
يَقُولُ اللهُ تَعَالَى : مَا لعَبدِي المُؤْمِنِ عِنْدِي جَزَاءٌ إِذَا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِنْ أهْلِ الدُّنْيَا ثُمَّ احْتَسَبَهُ إلا الجَنَّةَ
‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি যদি কোনো মুমিনের প্রিয়জনকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাই, আর সে সওয়াবের আশায় সবর করে, আমার কাছে তার প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/৯০, হা. নং ৬৪২৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
আনাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত , রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ : إِذَا ابْتَلَيْتُ عَبْدِي بِحَبِيبَتَيْهِ ثُمَّ صَبَرَ عَوَّضْتُهُ عَنْهُمَا الْجَنَّةَ يُرِيدُ عَيْنَيْهِ
‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি যদি কোনো বান্দাকে তার অতিপ্রিয় দুটি বস্তু কেড়ে নিয়ে পরীক্ষায় ফেলি আর সে তাতে সবর করে, তাহলে আমি সে দুটির বিনিময়ে তাকে জান্নাত দান করি। আনাস রা. বলেন, বস্তু দুটি হলো, তার দুই চোখ।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১১৬, হা. নং ৫৬৫৩, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
তিন : আল্লাহর মহান দরবারে অসুস্থ সবরকারীর জন্য উত্তম বিনিময়ের আলোচনা করা হয়।
আতা বিন ইয়াসার রহ. সূত্রে বর্ণিত , রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
إِذَا مَرِضَ الْعَبْدُ بَعَثَ اللَّهُ إِلَيْهِ مَلَكَيْنِ، فيَقَولونَ: انْظُرَا مَاذَا يَقُولُ لِعُوَّادِهِ؟ فَإِنْ هُوَ إِذَا جَاءُوهُ حَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ رَفَعَا ذَلِكَ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ أَعْلَمُ، فَيَقُولُ: لِعَبْدِي عَلَيَّ إِنْ تَوَفَّيْتُهُ أَنْ أُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ، وَإِنْ أَنَا شَفَيْتُهُ أَنْ أُبْدِلَهُ لَحْمًا خَيْرًا مِنْ لَحْمِهِ، وَدَمًا خَيْرًا مِنْ دَمِهِ، وَأَنْ أُكَفِّرَ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ.
‘বান্দা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, আল্লাহ তার কাছে দুজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তাদেরকে বলেন, নজর রেখো, আমার বান্দা (অসুস্থতার খবর শুনে) দেখতে আসা লোকদের কী বলে। সে যদি তাদের সামনে আল্লাহর হামদ বর্ণনা করে, প্রশংসা করে, ফেরেশতারা তা আল্লাহর কাছে নিয়ে যায়—যদিও আল্লাহ সব জানেন। অতঃপর আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা যদি মারা যায়, তবে আমার ওপর তার হক হলো, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব। আর যদি তাকে সুস্থতা দান করি, তবে তার (দেহের আক্রান্ত) মাংসপেশির বদলে আরও উত্তম মাংশপেশি দান করব এবং (দূষিত) রক্তের পরিবর্তে আরও উত্তম রক্ত দান করব। আর তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবো।’ (মুআত্তা মালিক : ৫/১৩৭৫, হা. নং ৩৪৬৫, প্রকাশনী : মুআসসাসাতু জায়িদ বিন সুলতান, আবুধাবি)
চার : সবরকারীদের অনন্য মর্যাদা দিয়ে স্পেশালভাবে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।
আমর ইবনে শুআইব রহ. তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
إِذَا جَمَعَ اللهُ تَعَالَى الْخَلَائِقَ نَادَى مُنَادٍ: أَيْنَ أَهْلُ الْفَضْلِ؟ فَيَقُومُ نَاسٌ هُمْ يَسِيرٌ، فَيَنْطَلِقُونَ سِرَاعًا إِلَى الْجَنَّةِ فَتَلَقَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ، فَيَقُولُونَ: إِنَّا نَرَاكُمْ سِرَاعًا إِلَى الْجَنَّةِ، فَمَنْ أَنْتُمْ؟ فَيَقُولُونَ: نَحْنُ أَهْلُ الْفَضْلِ، فَيَقُولُونَ: مَا كَانَ فَضْلُكُمْ؟ فَيَقُولُونَ: كُنَّا إِذَا ظُلِمْنَا صَبَرْنَا، وَإِذَا أُسِيءَ إِلَيْنَا غَفَرْنَا، وَإِذَا جُهِلَ عَلَيْنَا حَلُمْنَا، فَيُقَالُ لَهُمُ: ادْخُلُوا الْجَنَّةَ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ
‘আল্লাহ যখন (হাশরের ময়দানে) সকল মাখলুককে সমবেত করবেন, একজন ঘোষক ঘোষণা করবে, মর্যাদাবানরা কোথায়? তখন অল্প কিছু মানুষকে দাঁড়াতে দেখা যাবে। তাঁরা দ্রুত জান্নাতের দিকে এগিয়ে যাবে। পথে ফেরেশতাদের সঙ্গে দেখা হবে। তাঁরা জিজ্ঞেস করবে, আপনারা কারা? তাঁরা উত্তর দেবে, আমরা মর্যাদাবান। ফেরেশতারা পুনরায় জানতে চাইবে, আপনাদের মর্যাদার কারণ? তাঁরা বলবে, আমাদের কষ্ট দেওয়া হলে সবর করতাম, আমাদের সাথে মন্দ ব্যবহার করা হলে ক্ষমা করে দিতাম আর আমাদের সাথে মূর্খতার মতো আচরণ করা হলে ধৈর্যধারণ করতাম। তারপর তাঁদের বলা হবে, জান্নাতে প্রবেশ করুন। সৎকর্মপারয়ণদের প্রতিদান কতই না উত্তম!’ (শুআবুল ইমান : ১০/৪২২, হা. নং ৭৭৩১, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ)
পাঁচ : সবরের কারণে গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি হয়।
আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَا مِنْ مُصِيبَةٍ تُصِيبُ المُسْلِمَ إِلَّا كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا عَنْهُ، حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا
‘মুমিনের জীবনে যত বিপদ আসে, প্রতিটি বিপদের বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করেন; এমনটি কাঁটা ফুটলেও।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১১৪, হা. নং ৫৬৪০, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
আবু সাইদ রা. ও আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :
مَا يُصِيبُ المُسْلِمَ، مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ، وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ، حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا، إِلَّا كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ
‘মুসলিমের ওপর যে কষ্টক্লেশ, রোগব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এই সবগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১১৪, হা. নং ৫৬৪১, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُشَاكُ شَوْكَةً، فَمَا فَوْقَهَا إِلَّا كُتِبَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ
‘মুমিনের দেহে যদি কোনো কাঁটাও ফোটে কিংবা আরও অধিক কষ্ট আসে, এর বিনিময়ে আল্লাহ তার একটি গুনাহ ক্ষমা করেন এবং একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।’ সহিহু মুসলিম : ৪/১৯৯১, হা. নং ২৫৭২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَا يَزَالُ البَلاَءُ بِالمُؤْمِنِ وَالمُؤْمِنَةِ فِي نَفْسِهِ وَوَلَدِهِ وَمَالِهِ حَتَّى يَلْقَى اللَّهَ وَمَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ.
‘মুমিন নর-নারীর জীবনে, তাদের সন্তান-সন্ততিতে, ধন-সম্পদে একের পর এক বালা-মুসিবত আসতে থাকে; (আর তার পাপরাশি ক্ষমা হতে থাকে) এমনকি এক পর্যায়ে সে গুনাহবিহীন অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হয়।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৮০, হা. নং ২৩৯৯, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :
مَنْ وَعَكَ لَيْلَةً فَصَبَرَ , وَرَضِيَ بِهَا عَنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ خَرَجَ مِنْ ذُنُوبِهِ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
‘যে ব্যক্তি একরাত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ধৈর্যধারণ করে এবং আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তার পাপরাশি ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়—সে যেন সদ্যপ্রসূত এক শিশুতে পরিণত হয়।’ (শুআবুল ইমান : ১২/২৮৩, হা. নং ৯৪০২, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ)
ছয় : পরিপূর্ণভাবে সবরকারীর আমলনামা না দেখেই জান্নাত দেওয়া হবে।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরিল আ. থেকে বর্ণনা করেন :
اللَّه تَبَارَكَ وَتَعَالَى قَالَ: إِذَا وَجَّهْتُ إِلَى عَبْدٍ مِنِ عَبِيدِي مُصِيبَةً فِي بُدْنِهِ أَوْ مَالِهِ أَوْ وَلَدِهِ ثُمَّ اسْتَقْبَلَ ذَلِكَ بِصَبِرٍ جَمِيلٍ اسْتَحْيَيْتُ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنْ أَنْصُبَ لَهُ مِيزَانًا أَوْ أَنْشُرَ لَهُ دِيوَانًا
‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি যদি আমার কোনো বান্দার দেহে বা সন্তুান-সন্ততিতে কিংবা ধন-সম্পদে মুসিবত দিই, আর সে যদি এই মুসিবতকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয় এবং পরিপূর্ণভাবে ধৈর্যধারণ করে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য ‘মিজান’ বা হিসাবের পাল্লা দাঁড় করাতে কিংবা তার আমলের নথিপত্র খুলতে লজ্জাবোধ করি।’ (মুসনাদুশ শিহাব : ২/৩৩০, হা. নং ১৪৬২, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
সাত : সবর বা ধৈর্যধারণ হলো সবচেয়ে বিস্তৃত ও উত্তম নিয়ামত।
আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ عَطَاءً خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْرِ
‘সবরের চেয়ে উত্তম ও বিস্তৃত কোনো নিয়ামত কাউকে দেওয়া হয়নি।’ (সহিহুল বুখারি : ২/১২৩, হা. নং ১৪৬৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
আট : সবরের মাধ্যমে উন্নত মর্যাদায় পৌঁছানো হয়।
জনৈক সাহাবি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا سَبَقَتْ لَهُ مِنَ اللَّهِ مَنْزِلَةٌ، لَمْ يَبْلُغْهَا بِعَمَلِهِ ابْتَلَاهُ اللَّهُ فِي جَسَدِهِ، أَوْ فِي مَالِهِ، أَوْ فِي وَلَدِهِগ্ধ قَالَ أَبُو دَاوُدَ: زَادَ ابْنُ نُفَيْلٍ: ্রثُمَّ صَبَّرَهُ عَلَى ذَلِكَ - ثُمَّ اتَّفَقَا - حَتَّى يُبْلِغَهُ الْمَنْزِلَةَ الَّتِي سَبَقَتْ لَهُ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى
‘বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে যখন কোনো মর্যাদা নির্ধারিত হয়ে যায়, আর সে যদি স্বীয় আমলের মাধ্যমে মর্যাদার সেই স্তরে উপনীত হতে না পারে, তখন আল্লাহ তার দেহে, সম্পদে কিংবা সন্তান-সন্ততিতে মুসিবত দান করেন এবং তাকে সবর করার তাওফিক দেন। এভাবে তিনি তাকে উদ্দিষ্ট মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দেন।’ (সুনানু আবি দাউদ : ৩/১৮৩, হা. নং ৩০৯০, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যা, বৈরুত)
এমন আরও অনেক হাদিস ও আসার আছে, যা থেকে সবরের ফজিলত ও গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। এ পরিচ্ছেদে আমরা কুরআন ও হাদিস থেকে সবরের যে ফজিলত ও গুরুত্বের কথা জানতে পারলাম, জ্ঞানী মুমিনদের শিক্ষার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। এ নসগুলো সামনে রাখলে আমাদের জন্য যেকোনো বিপদ-মুসিবতে সবর করা সহজ হবে এবং আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা তৈরি হবে। আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : সবর অর্জনের উপায়
প্রথম পরিচ্ছেদে আমরা সবরের ফজিলত ও গুরুত্ব জানতে পেরেছি। বিবেকবানরা এতটুকুতেই নিজেদের মধ্যে সবরের গুণ পরিপূর্ণভাবে অর্জনে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু এটা যেহেতু অনেক কঠিন একটি বিষয়, শুধু ফজিলতের কথা শুনেই সবার পক্ষে তা অর্জন করা সম্ভব হয়ে ওঠবে না, তাই এ পরিচ্ছেদে আমরা দশটি উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব, যাতে সবাই সবরের গুণটি নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারে।
এক : বিপদে ইন্নালিল্লাহ পড়া্।
ব্যক্তির ওপর যখন কোনো বিপদ আপতিত হয় তখন প্রথমে إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ পড়ে নেওয়া উচিত। বিপদাপদে এই দুআ পাঠ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। এটি অন্তরে প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা এনে দেয় এবং ধৈর্যধারণের জন্য সহায়ক হয়।
উম্মে সালমা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: مَا مِنْ مُسْلِمٍ تُصِيبُهُ مُصِيبَةٌ، فَيَقُولُ مَا أَمَرَهُ اللهُ: إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا، إِلَّا أَخْلَفَ اللهُ لَهُ خَيْرًا مِنْهَا.
‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে মুসলিম কোনো বিপদে আক্রান্ত হয়ে আল্লাহ-নির্দেশিত দুআ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ পড়ে বলবে, اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا তাকে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই ওই বিপদের চেয়ে উত্তম প্রতিদান দান করবেন।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৬৩১, হা. নং ৯১৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
আম্মাজান উম্মে সালামা রা.-এর অবস্থার প্রতি একটু চিন্তা করে দেখুন! তিনি তাঁর স্বামী আবু সালামা রা.-এর ইনতিকালে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন আল্লাহুম্মা’জুরনি ফি মুসিবাতি ওয়া আখলিফ লি খাইরাম মিনহা’ পড়েছিলেন। ফলে আল্লাহ তাআলা ওই বিপদে তাঁকে উত্তম বদলা দিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী আবু সালামা রা.-এর চেয়ে উত্তম ব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন। তবে এই বিকল্প উত্তম প্রতিদান সর্বদাই দুনিয়াতে পাওয়াটা জরুরি নয়; বরং আল্লাহ চাইলে দুনিয়াতেও মিলতে পারে, নয়তো তিনি আখিরাতে দান করবেন। আবার কখনো এমনও হতে পারে যে, সবরে জামিলের দরুন উভয় জগতেই উত্তম প্রতিদান পাবে।
দুই : ধীরস্থিরতা অবলম্বন।
বিপদ আসলে অধিকাংশ মানুষ অস্থির ও পেরেশান হয়ে যায়। অথচ জ্ঞানীদের অজানা নয় যে, এতে বিপদ তো কমেই না; বরং আরও বৃদ্ধি পায়। তাই কোনো বিপদে আক্রান্ত হলে স্থির থাকার চেষ্টা করবে এবং বিষয়টি নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবে। এভাবে ভাবলে তার জন্য ধৈর্যধারণ করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যাবে। আর একবার ধৈর্য সহকারে কোনো বিপদ-মুসিবত নিয়ে চিন্তা করলে আল্লাহ যেকোনো একটা উপায় বের করে দেবেনই। এতে ভুল হওয়ার আশঙ্কাও খুব কম থাকে।
অন্তর যখন শান্ত হবে, মনোবল যখন শক্তিশালী থাকবে এবং অস্থিরতা যখন দূর হবে তখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও সহজ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মাজান আয়িশা রা.-কে সম্মোধন করে বলেছিলেন :
مَهْلًا يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ وَالعُنْفَ وَالفُحْشَ.
‘তুমি নিজের ওপর নম্রতা ও কোমলতাকে আবশ্যক করে নাও এবং কঠোরতা ও অশালীন কথা থেকে দূরে থাকো।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/১৩, হা. নং ৬০৩০, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
তিনি আরও বলেন :
إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ.
‘নিশ্চয় কোমলতা সব জিনিসকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। আর কোনো জিনিসে কোমলতা পরিহার করা হলে তা তাকে কলুষিত করে দেয়।’ (সহিহু মুসলিম : ৪/২০০৪, হা. নং ২৫৯৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
অস্থিরতা ও ক্রোধ কখনো কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। অস্থিরতা ও ক্রোধের শিকার হয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তে অনেক মানুষ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো আরও বড় বিপদে নিপতিত হয়েছে। তাই বিপদ ও মুসিবত যত বড়ই হোক না কেন নিজেকে স্থির রাখতে হবে, এরপর ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এতে অনেক সমস্যা আপনাআপনিই দূর হয়ে যাবে।
তিন : আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ।
বিপদে আক্রান্ত প্রতিটি মুমিনের ওপর আল্লাহ তাআলার প্রতি এ ধারণা পোষণ করা আবশ্যক যে, নিশ্চয় এ পার্থিব বিপদের মাঝেই আমার কোনো কল্যাণ আছে। তিনি যেমন বিপদ দিয়েছেন, ঠিক তিনিই আবার আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। কেননা, কাঠিন্যের সাথেই রয়েছে সহজতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا. إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا.
‘নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। (সুরা আল-ইনশিরাহ : ৫-৬)
আল্লাহর ব্যাপারে কখনো বিরূপ ধারণা রাখা যাবে না। পরিস্থিতি কখনো বিরূপ মনে হলেও হয়তো শীঘ্রই এর কল্যাণ উন্মোচিত হয়ে যাবে। তাই ধৈর্যের সাথে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। এভাবে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সুধারণা ঠিক করতে পারলে তার জন্য ধৈর্যধারণ করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
অনেক সময় মানুষ বিপদে বা সমস্যায় আসমান-জমিন এক করে ফেলে। যেন তাদের সামনে দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে আসে এবং ভাবে তাদের সবকিছুই যেন শেষ হয়ে গেছে! মানুষ একটা বিষয়কে অপছন্দ করে; অথচ পরে দেখা যায়, আর আল্লাহ এর মধ্যেই তার জন্য কল্যাণ রেখেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ
‘হয়তো তোমরা কোনো বিষয়কে অপছন্দ করো; অথচ সেটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর!’ (সুরা আল-বাকারা : ২১৬)
একটি ঘটনার প্রতি লক্ষ করুন। উমর রা.-এর কন্যা হাফসা রা. যখন বিধবা হলেন তখন উমর রা. তাঁকে আবু বকর রা.-এর কাছে পেশ করলেন। কিন্তু তিনি তাকে কোনো উত্তরই দিলেন না। এরপর তিনি উসমান রা.-এর নিকট প্রস্তাব পেশ করলে তিনি বললেন, আমার এখন বিবাহ করার ইচ্ছা নেই। উমর রা. তাঁদের জবাবে কষ্ট পেলেন এবং চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি তাঁর এ অবস্থার কথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জানালেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :
يَتَزَوَّجُ حَفْصَةَ مَنْ هُوَ خَيْرٌ مِنْ عُثْمَانَ؛ وَيَتَزَوَّجُ عُثْمَانُ مَنْ هِيَ خَيْرٌ مِنْ حَفْصَةَ
‘উসমান রা.-এর চেয়েও উত্তম ব্যক্তি হাফসা রা.-কে বিবাহ করবে। আর উসমান রা. হাফসা রা. থেকেও উত্তম মেয়ে বিবাহ করবে।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/২২৮, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাফসা রা.-কে নিজে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বিবাহ করেন। আর উসমান রা.-এর সঙ্গে স্বীয় কন্যা রুকাইয়া রা.-এর বিবাহ দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে হাফসা রা.-এর বিবাহের পর আবু বকর রা. উমর রা.-এর সাথে দেখা করলেন এবং অজুহাত পেশ করে বললেন, আপনি মনে কষ্ট রাখবেন না। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বিবাহের ইচ্ছায়) হাফসা রা.-এর কথা আলোচনা করেছিলেন। আর আমি তাঁর গোপন কথা (আপনার কাছে) প্রকাশ করতে পারছিলাম না। তিনি যদি তাঁর ইচ্ছা ত্যাগ করতেন তাহলে আমি তাঁকে অবশ্যই বিবাহ করতাম।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১৩, হা. নং ৫১২২, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
অতএব, পেরেশানি বা বিপদ আসলেই অস্থির না হয়ে অপেক্ষা করতে হবে এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে সবরের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে উত্তম বিনিময় দান করবেন।
চার : বিপদের কথা সবার কাছে প্রকাশ না করা।
সাধারণত মানুষ কোনো বিপদে আক্রান্ত হলে তা সবাইকে বলে দেয় এবং নিজের অস্থিরতার কথা প্রকাশ করে। এতে মানুষ তাকে সঠিক সমাধান তো দিতে পারেই না; উল্টো বিভিন্ন রকমের কথা শুনে তার পেরেশানি আরও বেড়ে যায়। আর এতে তার সবর করা কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে সব কথা প্রকাশ করার কারণে সবরের ফজিলত থেকেও বঞ্চিত হতে হয় এবং কোনো সমাধানের পথ বের করতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। বরং কখনো কখনো তো এভাবে নিজের বিপদাপদের কথা সবাইকে বলে বেড়ানোয় উল্টো তার ক্ষতি হয়।
নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি নির্দেশনা হলো :
مِنْ كُنُوزِ الْبِرِّ كِتْمَانُ الْمَصَائِبِ , وَالْأَمْرَاضِ, وَالصَّدَقَةِ
‘বিপদ-মুসিবত, অসুখ-বিসুখ ও সদকার কথা গোপন রাখা পূণ্যের কাজসমূহের মধ্যে অন্যতম।’ (শুআবুল ইমান : ১২/৩৭৭, হা. নং ৯৫৭৪, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ)
উসামা বিন জাইদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
إِنَّ لِلَّهِ مَا أَخَذَ، وَلَهُ مَا أَعْطَى، وَكُلٌّ عِنْدَهُ بِأَجَلٍ مُسَمًّى، فَلْتَصْبِرْ، وَلْتَحْتَسِبْ
‘আল্লাহ যা কেড়ে নেন আর যা দান করেন—সব তাঁরই অধিকারে। তাঁর কাছে সবকিছুরই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। কাজেই সে যেন ধৈর্যধারণ করে এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রাখে।’ (সহিহুল বুখারি : ২/৭৯, হা. নং ১২৮৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
তাই মুসিবতের বিষয়টি যদি গোপন রাখা সম্ভব হয় তাহলে তা গোপন রাখা আল্লাহ তাআলার একটি বড় নিয়ামত। এটা আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টি এবং অস্থিরতা প্রকাশ না করে অটল থাকার গোপন রহস্য। যেহেতু যথাসময়ে বিপদ ঠিকই কেটে যাবে, তাই মানুষের কাছে অভিযোগ প্রকাশ করে নিজের সবরের প্রতিদান নষ্ট করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। এক্ষেত্রে বিপদের কথা গোপন রাখলে তার জন্য সবর করা সহজ হয় এবং সর্বদা আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাস্তবতায় দেখা গেছে, মানুষের বিপদাপদ কেটে গেলে অন্যকে তার বিপদ ও গোপন বিষয়টি জানানোর কারণে সে মনেমনে লজ্জাবোধ করে। বিষয়টি যেহেতু এমনই, তাই শুরুতেই নিজের বিপদাপদের বিষয়টা প্রকাশ না করে গোপন রাখা উচিত।
পাঁচ : ক্রোধ দমন করা।
বিপদে অনেক সময় মানুষ ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। ক্রোধ আসলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান ঠিক থাকে না। তাই সবর করার জন্য ক্রোধ দমন করা খুবই জরুরি। যার ক্রোধ যত বেশি নিয়ন্ত্রিত তার সবরও তত তাড়াতাড়ি অর্জন হবে। ক্রোধ দমনের সাথে সবরের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই যেকোনো বিপদে আমাদের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
এক লোক নবি কারিম সা.-এর নিকট এসে বলল, আমাকে নসিহত করুন। তিনি বললেন :
لاَ تَغْضَبْ فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ: لاَ تَغْضَبْ
‘ক্রোধান্নিত হবে না। এরপর আরও কয়েকবার বললেন, ক্রোধান্নিত হবে না।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/২৮, হা. নং ৬১১৬, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
তিনি আরও বলেন :
لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ، إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الغَضَبِ
‘প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়; বরং সে-ই হলো আসল বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/২৮, হা. নং ৬১১৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
রাগ সঠিক ও সুস্থ চিন্তার জন্য অন্তরায়। রাগ মানুষকে বিক্ষিপ্ত ও অস্থির চিন্তার দিকে ঠেলে দেয়। আর তখন মানুষ আবেগী হয়ে যায়। আবেগের বসে সে অনাকাঙ্খিত কিছু করে ফেলে। সুতরাং প্রথমে ভালোভাবে স্থির ও শান্ত হতে হবে। এরপর উত্তম পদ্ধতিতে সমস্যার মুকাবেলা করতে হবে। অনেক জ্ঞানী মহিলা তাদের রাগী ও কর্কশ স্বামীর সাথে দয়া ও নম্রতার আচরণ করে। ফলে কিছু সময় পরেই আবার তার স্বামী তার কাছে ফিরে আসে। এসংক্রান্ত মানুষের অসংখ্য ঘটনা আছে। আর এ কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তাঁর নবি সা.-কে এর আদেশ দিয়ে বলেন :
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ۚ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
‘ভালো ও মন্দ সমান নয়। (তাদের কথার) জবাবে তাই বলুন, যা উৎকৃষ্ট; তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হা-মিম সাজদা : ৩৪)
অতএব রাগের ব্যাপারে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সবর অর্জন করা কখনো সম্ভব হবে না। রাগের ক্ষতিকর দিক ও এর খারাপ পরিণামের কথা চিন্তা করলে আশা করা যায় ধীরে ধীরে রাগ কন্ট্রোলে চলে আসবে ইনশাআল্লাহ। আর এটা কন্ট্রোলে চলে আসলে দ্রুতই সবর অর্জন হয়ে যাবে।
ছয় : বেশি বেশি ইসতিগফার পড়া।
বিপদের সময় সবরের সাথে অটল থাকার জন্য বেশি বেশি ইসতিগফার ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। কেননা, অধিকাংশ বিপদ আমাদের নিজেদের হাতের কামাই ও গুনাহের কারণে এসে থাকে। তাই ইসতিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলে আশা করা যায়, তিনি সবরের তাওফিক দেবেন এবং বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। হাদিসে এসেছে, রালুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَنِ أكْثَرَ مِنَ الاسْتِغْفَارِ، جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا، وَمِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا، وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
‘যে ব্যক্তি বেশি পরিমাণে ইসতিগফার পড়বে আল্লাহ তাআলা তাকে সকল পেরেশানি থেকে মুক্ত করবেন এবং সকল সংকীর্ণতা থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি করে দেবেন। আর তাকে তার ধারণাতীত রিজিক দান করবেন।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৪/১০৪, হা. নং ২২৩৪, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
আমাদের ওপর আল্লাহ তাআলার অনেক বড় একটি নিয়ামত এই যে, তিনি আমাদের জিহ্বাকে অনেক হালকা বানিয়েছেন এবং কোনো ধরনের কষ্ট ছাড়াই তার নড়াচড়ার ব্যবস্থা করেছেন। তাই বেশি বেশি করে ইসতিগফার পড়তে অলসতা ও কার্পণ্য না করা।
সাত : আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল করা।
বিপদ-মুসিবতে আল্লাহ তাআলার ওপর তাওয়াক্কুল করতে পারাটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় একটি নিয়ামত। দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবতের সময় সবর করার জন্য তাওয়াক্কুলের ভূমিকা অপরিসীম। আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করে তার ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থেকে সমস্যার সমাধানের জন্য দুআ করার মধ্যে অন্তরের প্রশান্তি রয়েছে। ইবাদত ও নৈকট্যের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে সবচে বড় মর্যাদা হলো আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করা এবং সকল বিষয় তাঁর ওপর ন্যস্ত করা।
তাওয়াক্কুলের মধ্যে মনের স্থিরতা, দিলের প্রশান্তি ও অন্তরের নিশ্চিন্ততা রয়েছে। যারা এই মহান গুণের অধিকারী, আল্লাহ তাআলা তাদের ভালবাসেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুল অবলম্বনকারীদের ভালবাসেন।’ (সুরা আলি ইমরান : ১৫৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করবে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন।’ (সুরা আত-তালাক : ৩)
প্রত্যেকেরই এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, সমস্যা সমাধানে যে চেষ্টা-মুজাহাদা ও কষ্ট-ক্লেশ সে করে, এগুলো আসবাব গ্রহণ ও মাধ্যম অবলম্বন ব্যতীত আর কিছুই না। সমস্যার সমাধান এবং সকল কিছুর পরিচালনা তো একমাত্র আল্লাহ তাআলাই করে থাকেন। তিনি যা চান তা-ই হয় এবং যা চান না তা হয় না।
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ، وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ، رُفِعَتِ الأَقْلاَمُ وَجَفَّتْ الصُّحُفُ.
‘আর জেনে রাখো, যদি সমগ্র জাতি তোমার কোনো উপকার করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে তারা তোমার ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তারা সবাই তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তারা তোমার ততটুকু ক্ষতিই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তাআলা তোমার তাকদিরে লিখে রেখেছেন। কলমসমূহ তুলে নেওয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/২৪৮, হা. নং ২৫১৬, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
আট : পরামর্শ করা।
মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সমস্যায় পতিত হয় তখন তা থেকে উদ্ধারের জন্য তার একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ও উত্তম ফিকিরের প্রয়োজন হয়। যোগ্য লোকের সাথে পরামর্শ করে সঠিক সিদ্ধান্ত পেলে তার জন্য সবর করা অনেক সহজ হয়ে যায়। সে বিপদের হাকিকত অনুভব করতে পারে এবং বাস্তবসম্মত চিন্তা করার পথ খুলে যায়। আল্লাহর অনুগ্রহে এটা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। এটা অভিযোগের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা, এখানে ব্যাপকভাবে সবাইকে নিজের কষ্টের কথা বলা উদ্দেশ্য হয় না; বরং জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়, যা শরিয়া-অনুমোদিত। তবে পরামর্শ করার জন্য মুত্তাকি ও আহলে ইলম লোক বাছাই করবে। যার তার কাছে পরামর্শের জন্য গেলে কল্যাণের পরিবর্তে উল্টো আরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
কুরআন-সুন্নাহয় পরামর্শের অনেক গুরুত্ব ও উপকারিতার কথা বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করতেন। সাধারণ বিষয় হলে সাধারণভাবে আর বিশেষ বিষয় হলে বিশেষ সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করতে বসতেন। গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতার বিবেচনায় কখনো শুধু একজন বা দুজনকে নিয়েই বসতেন। কুরআনেও আল্লাহ তাআলা পরামর্শ করার আদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
‘আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।’ (সুরা আলি ইমরান : ১৫৯)
আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণাগুণের বর্ণনা দিয়ে বলেন :
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
‘নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে তারা নিজেদের কাজ সম্পাদন করে।’ (সুরা আশ-শুরা : ৩৮)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَنْ أَرَادَ أَمْرًا فَشَاوَرَ فِيهِ امْرَأً مُسْلِمًا وَفَّقَهُ اللَّهُ لِأَرْشَدِ أُمُورِهِ
‘যে ব্যক্তি কোনো কাজের ইচ্ছা করে তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে, আল্লাহ তাকে সবচে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাওফিক দান করেন।’ (আল-মুজামুল আওসাত, তাবারানি : ৮/১৮১, হা. নং ৮৩৩৩, প্রকাশনী : দারুল হারামাইন, কায়রো)
উমর রা. বলেন, তুমি অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না। তোমার শত্রু চিনো এবং বন্ধু থেকে সতর্ক থাকো, তবে বিশ্বস্ত হলে ভিন্ন কথা। আর আল্লাহকে ভয়কারী ব্যতীত কোনো বিশ্বস্ত লোক নেই। তুমি কোনো পাপাচারী লোকের সাথে হাঁটাচলা করবে না, তাহলে সে তোমাকে তার পাপাচারিতা শিক্ষা দিবে। তার নিকট তোমার গোপন বিষয় প্রকাশ করবে না এবং তার সাথে তোমার কোনো বিষয় নিয়ে পরামর্শ করবে না। তবে যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, তার কথা ভিন্ন।
পরামর্শের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। প্রথমত, এমন লোকের সাথে পরামর্শ করবে, যার অবস্থান অনেক দূরে এবং সে নিজেও প্রচারমাধ্যম থেকে অনেক দূরে থাকে। যাতে করে সে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার গোপন বিষয়টা প্রকাশ না করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আহলে ইলমদের সাথে পরামর্শ করবে। তাদের সাথে পরামর্শ করলে দুইটি বিষয় একসাথে অর্জন হবে। এক. তাদের সাথে পরামর্শ করলে বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার তেমন ভয় থাকবে না। কারণ, তাদের কাছে এত মানুষ যাওয়া-আসা করে যে, কোনটা কার বিষয় সেটা তারা ভুলেই যান। তাই তা প্রকাশের বিষয়টিও আর সামনে আসবে না। দুই. তারা হলেন আহলে ইলম, পাশাপাশি মুত্তাকি ও পরহেজগার। তাই আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের পরামর্শের মধ্যে ইলম ও নুর উভয়টাই থাকবে।
নয় : সবরের ফজিলত ও পুরস্কার স্মরণ করা।
বিপদে পড়লে সবর করা কষ্টকর হলেও সবরের যে ফজিলত ও বিনিময় রয়েছে, তা স্মরণ করলে সবর করা অনেক সহজ হয়ে যায়। কেননা, মানুষের অন্তর কোনো কিছুর প্রাপ্তিতে অন্য কষ্টের কথা ভুলে যায়। তাই সবরের প্রতিদানের কথা চিন্তা করলে বর্তমান বিপদ ও কষ্ট অনেক তুচ্ছ মনে হবে এবং এর ওপর সবর করা সহজ হবে।
কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা জানতে পারি, যারা বিপদ-মুসিবতে ও দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয় তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা অফুরন্ত সওয়াব, প্রতিদান, উঁচু মর্যাদা ও পাপমোচন লিখে রেখেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ
‘নিশ্চয় যারা সবরকারী তাদেরকে অগণিত পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (সুরা আজ-জুমার : ১০)
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
مَا يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ مِنْ وَصَبٍ، وَلَا نَصَبٍ، وَلَا سَقَمٍ، وَلَا حَزَنٍ حَتَّى الْهَمِّ يُهَمُّهُ، إِلَّا كُفِّرَ بِهِ مِنْ سَيِّئَاتِهِ
‘মুমিন বান্দার যখন কোনো রোগ-ব্যধি, কষ্ট-মুসিবত, চিন্তা-পেরেশানি এবং তার কোনো ক্ষতিসাধন হয়; এমনকি তার যদি কোনো কাঁটাও বিঁধে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহু মুসলিম : ৪/১৯৯২, হা. নং ২৫৭৩, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
যখন ইবরাহিম রহ.-এর ইবাদগুজার মায়ের পা পশুর পায়ের আঘাতে ভেঙে গেল, অতঃপর লোকেরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আসল, তখন তিনি বললেন, দুনিয়ার মুসিবত না আসলে আমরা তো নিঃস্ব হয়ে আখিরাতে পুনরুত্থিত হব। উমর রা.-এর জুতার ফিতা ছিড়ে গেলে তিনি ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ে বললেন, কোনোভাবে তোমার কষ্ট হলে সেটাই তোমার জন্য মুসিবত। ইবনে আবিদ্দুনিয়া রহ. বলেন, সালাফে সালিহিন রাতের জ্বর কামনা করতেন, যাতে এর মাধ্যমে তাদের পূর্বের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُشَاكُ شَوْكَةً، فَمَا فَوْقَهَا إِلَّا كُتِبَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ
‘কোনো মুমিন বান্দার যদি কাঁটা বিঁধে বা অন্য কিছুর দ্বারা কষ্ট পায়, এর বিনিময়ে তার জন্য একটি মর্যাদা লিখে দেওয়া হয় এবং তার একটি ভুল মার্জনা করা হয়।’ (সহিহু মুসলিম : ৪/১৯৯১, হা. নং ২৫৭২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
ইমাম নববি রহ. এ হাদিসের ব্যখ্যায় বলেন, ‘এই হাদিসে মুসলমানদের জন্য এক মহাসুসংবাদ রয়েছে। কারণ, মানুষ খুব কম সময়ই এ সকল পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আর এতে তার রোগ-ব্যধি ও দুনিয়াবি কষ্ট-মুসিবতের মাধ্যমে তার গুনাহ ও ভুল-ত্রুটিগুলোরও কাফফারা হয়ে যাচ্ছে।’ (শারহু মুসলিম, নববি : ১৬/১২৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এসংক্রান্ত আরও অনেক আয়াত ও হাদিস প্রথম পরিচ্ছেদে গত হয়েছে। এসব ফজিলতের কথা অন্তরে থাকলে সবর করা তেমন কোনো কষ্টকরই হবে না। তাই সবরের আয়াত ও হাদিসগুলো আমাদের ইয়াদ করে সর্বদা মনে রাখা কর্তব্য, যেন বিপদের সময় এগুলো সবর অবলম্বনের জন্য সহায়ক হয়।
দশ : অধিক পরিমাণে মাসনুন দুআসমূহ আদায় করা।
মানুষ বিপদে পড়লে প্রথমেই মানুষের কাছে দৌড়ায়; অথচ বিপদে পড়লে কখন কী করতে হবে, তার সব নির্দেশনা শরিয়তে রয়েছে। তাই বিপদে আক্রান্ত হলে আমাদের প্রথমে দেখতে হবে, এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিস কী বলে। এতে যেসব দুআ ও জিকির শেখানো হয়েছে, তা যথাযথভাবে আদায় করলে দিল অনেক শান্ত হবে এবং বিপদের কাঠিন্যের ওপর সবর করা সহজ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বিপদ-মুসিবতের সময় অস্থিরতা ও পেরেশানি দূর করার দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি যখন কোনো বিষয়ে কষ্ট পেতেন তখন তিনি বলতেন :
يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ.
‘হে চিরঞ্জীব, হে অবিনশ্বর সত্তা, আমি আপনার রহমতের অসিলায় সাহায্য প্রার্থনা করছি।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৫/৪২৫, হা. নং ৩৫২৪, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
অন্য একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেরেশানি ও বিপদের সময় এই দুআ শিক্ষা দিয়েছেন :
اللهُ رَبِّي لَا أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا
‘আল্লাহ আমার রব। তাঁর সাথে আমি কোনো কিছুকে শরিক করি না।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৪৫/১৬, হা. নং ২৭০৮২, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
চিন্তা ও পেরেশানি থেকে মুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দুআ :
اللهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ، وَابْنُ عَبْدِكَ، ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ صَدْرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي
‘হে আল্লাহ, আমি আপনার এক দাস। আমি আপনার এক দাস ও দাসীর সন্তান। আমার সকল ফয়সালা আপনার হাতে। আপনার সকল হুকুম কার্যকর হয় এবং আপনার সকল ফয়সালাই ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি আপনার সকল নামের অসিলায়, যা আপনি নিজের জন্য রেখেছেন অথবা যা আপনি আপনার কিতাবে নাজিল করেছেন অথবা যা আপনি আপনার সৃষ্টির কাউকে শিক্ষা দিয়েছেন অথবা যা আপনার ইলমে গাইবের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আপনি কুরআনকে আমার কলবের বসন্ত বানান, আমার বক্ষের নুর বানান, আমার দুঃখ মোচনকারী বানান এবং আমার পেরেশানি দূরকারী বানান।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৭/৩৪১, হা. নং ৪৩১৮, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
হাদিসে আরও একটি দুআ পড়ার কথা এসেছে, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَالعَجْزِ وَالكَسَلِ، وَالجُبْنِ وَالبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট দুঃখ, পেরেশানি, অপারগতা, অলসতা, কৃপণতা, ভীরুতা, ঋণের গ্রাস ও মানুষের আধিপত্য থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/৭৯, হা. নং ৬৩৬৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
কোনো বিষয় কঠিন ও কষ্টকর হলে এই দুআ পড়বে :
اللَّهُمَّ لَا سَهْلَ إِلَّا مَا جَعَلْتَهُ سَهْلًا، وَأَنْتَ تَجْعَلُ الْحَزَنَ إِذَا شِئْتَ سَهْلًا
‘হে আল্লাহ, আপনি যা কিছু সহজ করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু সহজ নেই এবং আপনি চাইলে দুঃখকে সহজ করে দেন।’ (আ’মালুল ইয়াউমি ওয়াল লাইলা : পৃ. নং ৩১১, হা. নং ৩৫১, প্রকাশনী : দারুল কিবলা, জিদ্দা)
দুআর মাধ্যমে সব কিছুই অর্জন করা সম্ভব। এমনকি দুআর মাধ্যমে তাকদিরও পরিবর্তন হয়। হাদিস শরিফে এসেছে :
لاَ يَرُدُّ القَضَاءَ إِلاَّ الدُّعَاءُ
‘একমাত্র দুআই তাকদিরকে পরিবর্তন করতে পারে।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৬, হা. নং ২১৩৯, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
সুন্নাহর ভাণ্ডারে এ ধরনের দুআ ও জিকিরের সংখ্যা অগণিত। সব উল্লেখ করলে আলাদা একটি গ্রন্থ হয়ে যাবে। মূলত কেউ যদি এসব দুআ একিন ও বিশ্বাসের সাথে পড়ে তাহলে আল্লাহ তাআলা তার বিপদ থেকে তাকে মুক্তি দান করবেন এবং আরও উত্তম কিছুর ব্যবস্থা করে দেবেন। এসব দুআ মানুষের অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি আনয়ন করে, অন্তরের অস্থিরতা দূর এবং বিপদকে তুচ্ছ করতে শেখায়। এমন হলে তার জন্য সবর করা সহজ হয়ে যায় এবং সবরের বিনিময়ে সে উত্তম বিকল্প পায়। এতে সে দুনিয়া ও আখিরাত―উভয় জাহানে সফলতা লাভ করে। তাই বিপদাপদে আমাদের এসব মাসনুন দুআর প্রতি খুব মনোযোগী হওয়া দরকার। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
লেখকঃ Tarekuzzaman Tarek